National News

মেজর সিনহাকে গুলি করে হত্যা, কী হয়েছিল সেদিন

কক্সবাজারের টেকনাফে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান (৩৬) পুলিশের গুলিতে নিহতের ঘটনায় মাঠে নেমেছে তদন্ত দল। নিহত সাবেক সেনা কর্মকর্তার মা নাসিমা আক্তারকে মঙ্গলবার (৪ আগস্ট) ফোন করে সমবেদনা ও সান্ত্বনা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত মেজর রাশেদের মাকে এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন বলে নিহত রাশেদের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন।

এদিকে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৩ জুলাই ‘জাস্ট গো’ নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ট্রাভেল শো ডকুমেন্টারির শুটিংয়ের জন্য স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের আরো তিনজনসহ কক্সবাজারের নীলিমা রিসোর্টে ওঠেন মেজর সিনহা।

৩১ জুলাই দুজনকে হোটেলে রেখে সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে নিয়ে বিকাল ৪টার দিকে হোটেল থেকে টেকনাফের শামলাপুর পাহাড়ি এলাকায় গিয়েছিলেন মেজর সিনহা। রাত সাড়ে ৮টায় তারা দুজন পাহাড় থেকে নামেন এবং সিনহা নিজস্ব প্রাইভেট কারে মেরিন ড্রাইভ করে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দেন। শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে আসার আগে বিজিবি চেকপোস্টে সিনহার গাড়ি তল্লাশির জন্য থামানো হয়। তবে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।

মেজর সিনহাকে গুলি করে হত্যা, কী হয়েছিল সেদিন

রাত ৯টায় শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে আসার আগেই এসআই লিয়াকত ডাকাত সন্দেহে অবহিত হয়ে সঙ্গীয় ফোর্সসহ মেজর সিনহার গাড়ি থামান। মেজর সিনহা গাড়ি থামিয়ে নিজের পরিচয় দিলে প্রথমে যাওয়ার অনুমতি দিলেও একটু পরই অকস্মাৎ এসআই লিয়াকত তাদের পুনরায় থামার সংকেত দেন। পিস্তল তাক করে তাদের দিকে এগিয়ে আসেন।মেজর সিনহার সঙ্গী সিফাতের দেওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, মেজর সিনহা পুলিশের নির্দেশনা পাওয়ার পরপরই পিস্তল গাড়িতে রেখে হাত উঁচু করে বের হন।

এসআই লিয়াকত কোনো কথা না বলেই গাড়ি থেকে নামার পরপরই সিনহাকে লক্ষ্য করে ৩ রাউন্ড গুলি করেন। আর সিফাতকে আটক করে তিনি বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রে নিয়ে যান।গুলি করার পরপরই স্থানীয় লোকজন ও সেনাবাহিনীর এএসইউর সার্জেন্ট আইয়ুব আলী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে রাত ৯টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত মেজর সিনহাকে জীবিত দেখতে পান। সার্জেন্ট আইয়ুব ঘটনার ভিডিও করতে চাইলে পুলিশ তার পরিচয় জানতে চায়। পরিচয় পাওয়ার পরও পুলিশ তার মোবাইল ফোন ও পরিচয়পত্র ছিনিয়ে নেয়।

রাত আনুমানিক ৯টা ৪৫ মিনিটে গুলিবিদ্ধ পুলিশ একটি মিনি ট্রাক ঘটনাস্থলে আনে। মিনি ট্রাকের চালকও বলেছেন, ট্রাকে ওঠানোর সময়ও মেজর সিনহা জীবিত ছিলেন। নড়াচড়া করছিলেন। রাত ১০টার দিকে ট্রাকটি কক্সবাজার সদর হাসপাতালের দিকে রওনা করে। প্রায় ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পর ট্রাকটি মেজর সিনহাকে নিয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে প্রবেশ করে। হাসপাতালে আনার আগেই সিনহা মারা গেছেন বলে নিশ্চিত করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক।

ওই প্রতিবেদনে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, কক্সবাজার সদর হাসপাতাল থেকে ঘটনাস্থলের দূরত্ব বিবেচনায় সর্বোচ্চ এক ঘণ্টার মধ্যে ট্রাকটি হাসপাতালে পৌঁছানোর কথা। সিনহার শরীরের ওপরের অংশ কর্দমাক্ত এবং বুক ও গলা গুলিবিদ্ধ। তার হাতে হাতকড়া লাগানোর দাগ ছিল।

মেজর সিনহাকে গুলি করে হত্যা, কী হয়েছিল সেদিন

এদিকে মেজর সিনহা হত্যার ঘটনায় টেকনাফ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিতের দায়ের করা মামলায় একমাত্র আসামি করা হয়েছে সিনহার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম ওরফে সিফাতকে।

সিফাতের অপরাধ, পরস্পর (সিনহা ও সিফাত) যোগসাজশে সরকারি কাজে বাধা, হত্যার উদ্দেশ্যে অস্ত্র তাক করা ও মৃত্যু ঘটানো। এর বাইরেও সিনহা মো. রাশেদ খান ও সাহেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনেও মামলা করেছে পুলিশ। উদ্ধার দেখানো হয়েছে ৫০টি ইয়াবা ও ২৫০ গ্রাম গাঁজা।

নন্দদুলাল রক্ষিতের দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ৩১ জুলাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা পরেন এমন পোশাক পরা এক ব্যক্তিসহ দুজন মেরিন ড্রাইভ দিয়ে কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছেন, টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাস ওই খবর আগেই পেয়েছিলেন। তার নির্দেশেই শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে যানবাহন তল্লাশির কাজ শুরু হয়। ফাঁড়ির ইনচার্জের পিস্তল থেকে চারটি গুলি ছোড়ার কথা উল্লেখ আছে। তবে তার মৃত্যুর দায় চাপানো হয়েছে সিনহা রাশেদ ও তার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম সিফাতের ওপর।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, কমিউনিটি পুলিশের সদস্য নুরুল আমিন (২১) রাত সাড়ে ৮টার দিকে ফাঁড়ির ইনচার্জকে মুঠোফোনে জানান, কয়েকজন ডাকাত পাহাড়ে ছোট ছোট টর্চলাইট জ্বালিয়ে এদিক-সেদিক হাঁটাহাঁটি করছে। নুরুল আমিন এ কথা নিজামউদ্দিন ও আরও চারজনকে জানান। স্থানীয় মারিশবুনিয়া নতুন মসজিদের মাইকে পাহাড় থেকে ডাকাত নেমে আসছে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। ডাকাত প্রতিহত করতে এলাকার সবাইকে একত্র হতে বলা হয়। কিছুক্ষণ পর রাশেদ ও সিফাত নেমে আসেন। ওই সময় ঘটনাস্থলে ২০ থেকে ৩০ জন ছিলেন।

এজাহারে আরো বলা হয়, পাহাড় থেকে নেমে আসা দুজনকে শনাক্ত করার জন্য তাদের দিকে মো. মাঈন উদ্দীন নামে (১৯) এক ব্যক্তি তার হাতে থাকা টর্চলাইটের আলো ফেললে সেনাবাহিনীর পোশাক পরা একজন অস্ত্র উঁচিয়ে তাকে গালি (প্রকাশ অযোগ্য) দেন। এলাকার লোকজনকে ধাওয়া করলে তারা অস্ত্রের ভয়ে নিরাপদ জায়গায় অবস্থান নেন।

পরে তারা দুজন সিলভার রঙের প্রাইভেট কারে করে মেরিন ড্রাইভ হয়ে কক্সবাজারের দিকে রওনা হন। এ খবর নুরুল আমিন নামে এক ব্যক্তি বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জকে জানান। ইনচার্জ জানান টেকনাফ থানার ওসিকে। তার নির্দেশে বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলীর নেতৃত্বে রাত সোয়া ৯টার দিকে শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে যানবাহন তল্লাশি শুরু হয়।

নন্দদুলাল রক্ষিত এজাহারে বলেন, মিনিট বিশেক পর তল্লাশিচৌকির সামনে থামার জন্য প্রাইভেট কারকে সংকেত দেওয়া হয়। কিন্তু গাড়িটি সংকেত অমান্য করে তল্লাশিচৌকি অতিক্রমের চেষ্টা করে। একপর্যায়ে ইনচার্জ লিয়াকত আলী তল্লাশিচৌকিতে থাকা ব্লক দিয়ে গাড়িটির গতি রোধ করেন এবং হাত উঁচিয়ে গাড়ির ভিতরে থাকা ব্যক্তিকে বের হতে বলেন। ওই সময় গাড়িচালকের আসনে থাকা ব্যক্তি তর্ক শুরু করেন। তিনি নিজেকে সেনাবাহিনীর মেজর বলে পরিচয় দেন।

তার পাশে বসা ব্যক্তিটি গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। ফাঁড়ির ইনচার্জ এ সময় চালকের আসনে বসা ব্যক্তিকে গাড়ি থেকে নেমে হাত মাথার ওপর উঁচু করে ধরে দাঁড়াতে বলেন এবং বিস্তারিত পরিচয় জানতে চান। কিছুক্ষণ তর্ক করার পর সেনাবাহিনীর মেজর পরিচয় দেওয়া ব্যক্তি গাড়ি থেকে নেমে কোমরের ডান পাশ থেকে পিস্তল বের করে গুলি করতে উদ্যত হন। “আইসি” স্যার (লিয়াকত আলী) নিজের ও সঙ্গীয় ফোর্সদের জানমাল রক্ষার্থে সঙ্গে থাকা পিস্তল দিয়ে চারটি গুলি করেন।

মামলার এজাহারে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, টেকনাফ মডেল থানা এলাকার বাহারছড়া পাহাড়ি এলাকা। এ এলাকায় আগে থেকেই ডাকাত দলের সক্রিয় অবস্থান ছিল। এ এলাকায় অভিযান চালিয়ে সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর পোশাকসহ অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার হয়। নানা সময় সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর পোশাক পরে বাড়িঘরে লুটপাট করা হয়েছে বলে ব্যাপক জনশ্রুতি আছে। সিনহা মো. রাশেদের পরনে সেনাবাহিনীর সদস্যরা পরেন এমন পোশাক থাকায় লোকজন তাকে ডাকাত ভেবে ধাওয়া দেন।

এদিকে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা রাশেদ খানের মা নাসিমা আক্তারকে ফোন করেন। নাসিমা আক্তার বলেন, সকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ফোন করেছিলেন। ছেলের এমন মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী সান্ত্বনা ও সমবেদনা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিচার হবে।

এদিন কক্সবাজার হিলডাউন সার্কিট হাউজে সকাল সাড়ে ৯টায় শুরু হওয়া তদন্ত কমিটির বৈঠক দীর্ঘ ৬ ঘণ্টাব্যাপী চলে। বৈঠক শেষে বিকাল সাড়ে ৩টায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্তদলের প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, আগামী সাত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।

প্রসঙ্গত, নিহত সেনা কর্মকর্তা সিনহার বাড়ি যশোরের বীর হেমায়েত সড়কে। তার বাবা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপসচিব মুক্তিযোদ্ধা মরহুম এরশাদ খান। রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে ২০০২ সালে সিনহা এইচএসসি পাস করেন তিনি। সিনহা ৫১ বিএমএ লং কোর্সের সঙ্গে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কমিশন লাভ করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় নিয়োজিত স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সেও (এসএসএফ) দায়িত্ব পালন করেন। মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান ২০১৮ সালে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।

গত সোমবার (৩ আগস্ট) সামরিক মর্যাদায় বনানীর সামরিক কবরস্থানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানের দাফন সম্পন্ন হয়।

পাঠকের মতামত:

Back to top button