Miscellaneous News

অসংখ্য যুবকের সঙ্গে তূর্ণার ঘনিষ্ঠতা! হাতিয়ে নিত টাকা

রাহাত আরা খানম তূর্ণা ওরফে ফারজানা মহিউদ্দিনের প্রতারণার জাল ঢাকা থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গড়েছিলো। ঘনিষ্ঠতা ছিল প্রভাবশালীদের সঙ্গে। বেপরোয়া জী’বন যাপনে প্রয়োজন ছিল বিপুল অর্থের। তাই সহজেই মিশে যায় অন্ধকার জগতে।

প্রতারণা করে মাসে গড়ে দুই লাখ টাকা আয় হতো তার। এই চক্রে অন্তত দুই শতাধিক দেশি-বিদেশি সদস্য রয়েছে। তাদের গ্রে’প্তার করতে তৎপরতা চালাচ্ছে ক্রি’মিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি)। তূর্ণাকে গ্রে’প্তারের পর আদালতের নি’র্দেশে রাখা হয়েছে কাশিমপুর কারাগারে।

শিগগিরই তাকে রি’মান্ডে নিয়ে জি’জ্ঞাসাবাদ করবে সিআইডি। মিরপুর-১০ এর তিন নম্বর রোডের বেনারশি পল্লীর ৩৯/ডি২ বাড়ির ১০ তলায় থাকতো প্রতারক চক্রের নাইজেরিয়ান সদস্যরা। দ্বিতীয় তলা ব্যবহার করতো অফিস হিসেবে। চারতলায় থাকতো তূর্ণা।

ওই ফ্ল্যাটে একাই থাকতো সে। বাসা ভাড়া নেয়া হয় নাইজেরিয়ান নাগরিক ডেনিসের নামে। এছাড়াও মিরপুর ১১-এর সি ব্লকের পাঁচ নম্বর এভিনিউয়ে ছিল চক্রের আরেক আস্তানা। নাইজেরিয়ান ও দেশি বন্ধুদের মিলনমেলায় পরিণত হতো তার বাসা। ওই আড্ডায় অংশ নিতো তানিম নামের এক যুবক ব্যবসায়ী।

তূর্ণার বয়ফ্রেন্ড হিসেবে পরিচিত রাজশাহীর ওই যুবককে রাত-বিরাতে ওই বাসায় আসা-যাওয়া করতে দেখেছেন প্রতিবেশীরা। তানিম ছাড়াও সুফি ফারুক নামে আরেক যুবকের সঙ্গে তার রয়েছে ঘনিষ্ঠতা।

প্রত্যক্ষদর্শী ও ত’দন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এরকম অনেক যুবকের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার প্র’মাণ পাওয়া গেছে। প্রতিটি সম্পর্কের ক্ষেত্রেই তূর্ণার উদ্দেশ্য থাকতো টাকা। বিত্তশালী বন্ধুদের খোলামেলা ছবি পাঠিয়ে আকৃ’ষ্ট করতো তূর্ণা। সেই সঙ্গে আবেগপ্রবণ কথা বলার এক পর্যায়ে টাকা খুঁজতো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্রী থাকাবস্থায় গুরুকুল নামে একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করে তূর্ণা। ওই সময়ে পরিচয় হয় প্রভাবশালী কয়েক জনের সঙ্গে। জ’ড়িয়ে যায় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির এক নেতা ও সাবেক এমপির ছেলে, তিনি নিজেও আওয়ামী লীগের একটি উপ-কমিটির সদস্য। প্রায়ই টকশোতে কথা বলেন। তূর্ণার সঙ্গে তার দহরম মহরমের তথ্য প্র’মাণ পাওয়া গেছে। গ্রে’প্তারের কিছুদিন আগেও তূর্ণাকে একান্তে ডেকেছিলেন তিনি।

ওই সময়ে প্রতারণার কাজে ব্যস্ত তূর্ণা ক’রোনার দোহাই দিয়ে তাকে এড়িয়ে যায়। ২০১৮ সালে অন্ধকার জগতে পা রাখে। ওই বছর নিউ মার্কেট এলাকায় নাইজেরিয়ান নাগরিক ডেনিসের সঙ্গে পরিচয়। ডেনিস ও জুসেফের সঙ্গে সহজেই সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার।

ডেনিসের হাত ধ’রেই প্রতারক চক্রের সঙ্গে মিশে যায় সে। ওই চক্র প্রতিদিন আট থেকে ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতো বিভিন্নজনের কাছ থেকে। ত’দন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিনের পুরনো ফেসবুক আইডি হ্যা’ক করতো এই চক্র। চক্রের সদস্যরা অন্তত দুই শতাধিক আইডি হ্যা’ক করেছে।

পুরাতন আইডি ও বিপুল মিউচুয়াল ফ্রেন্ড থাকার কারণে টা’র্গেটকৃতের বিশ্বাস অর্জন সহজ হয়। বন্ধুত্বের এক পর্যায়ে বিপুল অর্থের গিফট সামগ্রীর এয়ারলাইন্স বুকিংয়ের ভু’য়া ডকুমেন্ট পাঠায়। গিফট বক্সে কয়েক মিলিয়ন ডলারের মূল্যবান সামগ্রী রয়েছে বলেও ভুক্তভোগীকে জানায়।

এক পর্যায়ে কাস্টমস কমিশনার সেজে টা’র্গেটকৃত ব্যক্তিকে কল করে তূর্ণা। জানানো হয় পার্সেল এসেছে। এতে স্বর্ণ ও ডলার রয়েছে। শুল্ক পরিশো’ধ করে নিতে হবে। বিপুল টাকার গিফটের আশায় সহজেই তিন থেকে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত পরিশো’ধ করতেন অনেকে। এই টাকা নেয়া হতো ডাচ-বাংলা এজেন্ট ব্যাংকের একাউন্টে।

সিআইডির বিশেষ পু’লিশ সুপার শামসুন নাহার বলেন, অন্তত দুই বছর আগে থেকেই এই চক্রের হয়ে কাজ করছে তূর্ণা। সে বেপরোয়া। এই চক্রের সদস্যরা ঘনঘন ফোন পরিবর্তন করতো। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে স’চেতন ছিল। তাই দীর্ঘদিন তাদের কেউ গ্রে’প্তার করতে পারেনি।

সিআইডি তাদের গ্রে’প্তার করতে সক্ষম হয়েছে। প্রতারকদের ব্যবহৃত ব্যাংকের ৩৫টি একাউন্টের তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ, ভারতের রাজস্থান, কলকাতা, কুয়েত, আমেরিকা, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে এই চক্রের এজেন্ট রয়েছে। বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা এই চক্রের প্রতারণার শিকার।

এ বিষয়ে তাদের পর্যায়ক্রমে রি’মান্ডে এনে জি’জ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ ঘ’টনায় জ’ড়িত কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলে জানান তিনি। গত ২১ জুলাই রাজধানীর পল্লবী এলাকা থেকে তূর্ণা সহ ১৩ জনকে গ্রে’প্তার করে সিআইডি। পরদিন (২২ জুলাই) ঢাকা মহানগর হাকিম মঈনুল ই’সলাম তাদের কারাগারে পাঠানোর আ’দেশ দেন। তাদের সাত দিনের রি’মান্ড আবেদন করা হয়।

ত’দন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, তূর্ণার নেতৃত্বে প্রতারক চক্র কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রতিদিন তাদের ব্যাংক হিসাবে জমা হতো প্রতারণার আট থেকে ১০ লাখ টাকা। নেত্রকোনা জে’লার সদরের দক্ষিণ নাগড়ার ৪০ নম্বর বাসার আহসান উল্লাহর মেয়ে তুর্ণা।

বাবা বিমান বা’হিনীতে কাজ করার সুবাধে বেড়ে উঠেন চট্টগ্রামে। পরে তিনি অবসর গেলে সপরিবারে চলে আসেন ঢাকায়। রাজধানীর বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে এইচএসসি ও বিএএফ শাহীন কলেজ, চট্টগ্রাম থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি।

তুর্ণা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১১-২০১২ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। স্নাতক শেষ করেন ২০১৫ সালে আর ২০১৬ সালে। জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১-২০১২ সেশনের ছাত্রী তূর্ণা মূলত উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত। সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে টকশোতেও বেশকয়েকবার অংশ নিয়েছেন। সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও বেশ পরিচিত ছিল তুর্ণা। সখ্যতা ছিল সব মহলে।

সিআইডির জি’জ্ঞাসাবাদে তূর্ণা জানিয়েছেন, এক একটি হিসাব নম্বরে সাত-আট জনের টাকা নেয়া হতো। তারপরই হিসাব নম্বর ব’ন্ধ করে দেয়া হতো। বিভিন্ন জনের নামে এসব হিসাব খোলা হতো। টাকা জমা হলে সুবিধাজনক শাখা থেকে তা উত্তোলন করা হতো।

পল্লবী থা’নায় দা’য়েরকৃত মা’মলার ত’দন্তকারী কর্মক’র্তা সিআইডির ঢাকা মেট্রো পশ্চিম ইউনিটের উপ-পরিদর্শক (এসআই) নিউটন কুমার দত্ত জানান, এটি আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্র। এতে জ’ড়িত অন্যদেরও গ্রে’প্তারের চে’ষ্টা চলছে। জানা গেছে, পড়ালেখা শেষে চাকরি খুঁজছিলো রাহাত আরা খানম তূর্ণা।

তা প্রায় দেড় বছর আগের কথা। নিউমার্কেট এলাকায় পরিচয় হয় ডেনিস নামে এক নাইজেরিয়ানের সঙ্গে। কথা বলার একপর্যায়ে ডেনিস তাকে চাকরির প্রস্তাব দেয়। মার্চেন্ডাইজিংয়ের নামে অফিস খুলেছিলো নাইজেরিয়ান প্রতারকরা। অল্পদিনেই নাইজেরিয়ানদের সঙ্গে বন্ধুতা গড়ে তোলে তূর্ণা।

তাদের মধ্যে একজনের সঙ্গে সহজেই তার ঘনিষ্ঠতা হয়। রাতারাতি বিপুল অর্থের মালিক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে যায় এই তরুণী। তাদের প্রতারণা ব্যবসার পুঁজি সাতটি ল্যাপটপ, ২১টি বিভিন্ন মডেলের মোবাইল ফোন এবং অসংখ্য সিম। ভারতের রাজস্থান, কলকাতা, কুয়েত, আমেরিকা, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা এই চক্রের প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চক্রের সদস্যরা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত দেড় বছর ধরে অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই চক্র। গত দুই মাসেই শতাধিক ভুক্তভোগীর কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ৬ কোটি টাকা।

ভুক্তভোগীদের অ’ভিযোগের প্রেক্ষিতে সিআইডির অতিরিক্ত পু’লিশ সুপার জাকির হোসাইনের নেতৃত্বে গত ২১ জুলাই ওই বাসা থেকেই প্র’তারকদের গ্রে’প্তার করেছে সিআইডি।

পাঠকের মতামত:

Back to top button